সুরা আল-ক্বদর:-
আ’উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম। বিসমিল্লাহির-রাহমানির রাহীম।
(১) আমি কুরআনকে নাযিল করেছি ক্বদরের রাতে।
(২) তুমি কি জান, ক্বদরের রাত কী?
(৩) ক্বদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও উত্তম।
(৪) এ রাতে ফেরেশতা আর রূহ (জিব্রাঈল আঃ) তাদের রব্বের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক কাজে অবতীর্ণ হয়।
(৫) (এ রাতে বিরাজ করে) শান্তি আর শান্তি, ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত।
_____________________________
লাইলাতুল ক্বদর কোন দিনে, এ্টা আল্লাহ আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে জানান নি। তবে বিভিন্ন হাদীস সমূহ একত্রিত করে এতোটুকু বলা যায়ঃ লাইলাতুল ক্বদর রমযান মাসের শেষ দশ দিনের যেকোন এক বেজোড় রাত্রিতে রয়েছে। অর্থাৎ, রমযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯ তারিখ রাতে। এর মাঝে কোন কোন আলেম মনে করেন, এটা ২৭ তারিখের রাতে রয়েছে। কিন্তু এটার উপরে নির্ভর করা নিরাপদ নয়। ২৭ তারিখে লাইলাতুল ক্বদর আশা করে সেইদিন ইবাদতের ব্যপারে বেশি জোর দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু, রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপদেশ অনুযায়ী রমযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯ তারিখে – এই সবগুলো রাতেই লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করতে হবে।
আমাদের দেশে এবার ২১শে রমযানের রাত্রি হচ্ছে আগামী ২৬শে জুন, রবিবার রাতে। সে হিসাবে বেজোড় রাত্রিগুলোতে ইবাদতের ব্যপারে যত্নশীল হতে হবে।
_____________________________
লাইলাতুল ক্বদরের রাতটি চেনার কিছু আলামত সহিহ হাদীসে পাওয়া যায়। তা নিন্মরুপঃ
(১) রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
(২) নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।
(৩) মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।
(৪) সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
(৫) কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন।
(৬) ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
(৭) সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত।
সহীহ ইবনু খুযাইমাহঃ ২১৯০, সহীহ বুখারীঃ ২০২১, সহীহ মুসলিমঃ ৭৬২।
_____________________________
লাইলাতুল ক্বদরে যেই আমলগুলো করতে হবেঃ
(১) নামাযঃ দুই রাকাত, দুই রাকাত করে তারাবীহ বা তাহাজ্জুদের নামায পড়বেন। এই নামাযে সুরা ক্বদর বা সুরা ইখলাস এতোবার পড়তে হবে, এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। অন্য যেকোনো নফল নামাযের মতোই দুই রাকাত নফল নামায পড়বেন। চেষ্টা করবেন দীর্ঘ কিরাতে নামায লম্বা করার জন্য। বড় সুরা না পারলে এক রাকাতে ছোট সুরা ২-৩টা পড়ে বড় করা যাবে।
নিচের আমলগুলো ঋতুবতী নারীসহ সকলেই করতে পারবেনঃ
(২) কুরআন তেলাওয়াত। আরবী কুরান স্পর্শ না করে ঋতুবতী নারীরা মুখস্থ অথবা বাংলা অর্থ দেওয়া আছে এমন কুরান থেকে, মোবাইল থেকে বা হাতে রুমাল বা কাপড় দিয়ে স্পর্শ করে কুরআন পড়তে পড়তে পারবে, আলেমদের এই মতটাই সঠিক। তবে সন্দেহের কারণে কেউ ক্বুরান তেলাওয়াত করতে না করতে চাইলে, অথবা যেই সমস্ত আলেম ঋতুবতী নারীদের কুরান তেলাওয়াত হারাম মনে করেন, এটার সাথে একমত হলে, কুরানের তাফসীর, হাদীস, দ্বীনি অন্যান্য বই-পুস্তক পড়তে পারেন।
(৩) তোওবাহঃ সারা জীবনের সমস্ত গুনাহর জন্য কান্নাকাটি করে তোওবা করা ও মাফ চাওয়া। বাংলা বা আরবী যেকোনো ভাষায়, অতীতের ভুলের জন্য লজ্জিত হয়ে আন্তরিকভাবে ভবিষ্যতে আর না করার সংকল্প নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আরবীতে করতে চাইলে – আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া আতুবু ইলাইহি – হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি ও তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি, এতোটুকু পড়ে বা ক্বুরান হাদীসের অন্য দুয়া দিয়ে তোওবা করা যাবে।
(৪) দুনিয়া ও আখেরাতের সমস্ত কল্যানের জন্য দুয়া করা। নিজের জন্য, মাতা পিতা বা ভাই বোন, স্ত্রী-সন্তান ও জীবিত ও মৃত সমস্ত মুসলমানদের জন্য দুয়া করতে হবে।
(৫) জান্নাতুল ফিরদাউস পাওয়ার জন্য দুয়া করতে হবে।
(৬) যিকির আযকারঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ১০০বার, ৩৩ বার সুবাহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহাদাহু লা শারীকালাহু…… ১০ বার বা ১০০ বার করে সহ, লা হাউলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ। আরো দুয়া পড়ার জন্য হিসনুল মুসলিম দেখুন। মুখস্থ না পারলে বই খুলে পড়তে পারবেন। আরবী দুয়াগুলো না পারলে বাংলাতেই পড়ুন।
(৭) দুরুদঃ দুরুদের ইব্রাহীম বা নামাযে যেই দুরুদ পড়া হয় সেটা পড়াই সবচাইতে বেশি সওয়াব। আর দুরুদের হাজারী, লাখী, জামিল, মাহী, দুরুদে আকবর এইরকম যত্তগুলো দুরুদ দেওয়া আছে ওযীফার বেদাতী কিতাবে – এইসবগুলো দুরুদ হচ্ছে বানোয়াট বেদাতী দুরুদ, এর ফযীলত যা দেওয়া আছে সমস্তটাই হচ্ছে ধোঁকা। এইগুলো পড়া বেদাত ও হারাম।
(৮) সাধ্যমতো কিছু দান-সাদাকাহ করতে পারেন। দান ছোট হোক, কোনটাই কম নয়, এমনকি হাদীস শুকনো একটা খেজুর দান করে হলেও জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্যে চেষ্টা করতে বলা হয়েছে।
(৯) জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্যে ফকীর মিসকীনকে খাদ্য দেওয়া অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটা ইবাদত, সুতরাং শবে কদরের রাতে সম্ভব হলে গরীবকে খাবার দিতে পারেন।
(১০) রাতের বেলা সুরা ইখলাস তেলাওয়াত করা সুন্নত। সুতরাং শবে কদরের রাত্রিগুলোতে সুরা ইখলাস পড়তে পারেন। সুরা ইখলাস তিন বার পড়লে একবার কুরান খতম দেওয়ার সমান সওয়াব পাওয়া যায়। সুরা ইখলাস দশ বার পড়লে আল্লাহ তার জন্যে জান্নাতে একটা প্রাসাদ নির্মান করবেন (মুসনাদে আহমাদ)
(১১) প্রতিদিন রাতের বেলা সুরা মুলক ও সুরা সিজদাহ পড়া সুন্নত। সুতরাং আপনারা কুরান তেলাওয়াতের সময় এই দুইটি সুরা পড়ে নেবেন।
(১২) এছাড়া মাগরিব, এশা ও ফযর ওয়াক্ত মতো সুন্দরভাবে আদায় করবেন, সুন্নত নামায সহকারে। ফরয নামাযের পরে যিকিরগুলো করবেন, নামায দীর্ঘ ও সুন্দর করতে চাইলে রুকু সিজদাহর তাসবীহ বেশি করে পড়বেন, নামাযে বিভিন্ন সময়ে যেই দুয়া আছে সেইগুলো পড়বেন। নামাযে বেশি বেশি দুয়া করবেন।
(১৩) ঘুমানোর পূর্বের যিকির-আযকারগুলো করবেন। আযানের জবাব ও দুয়া পড়বেন।
(১৪) তাহিয়াতুল ওযুর নামায পড়তে পারেন। তোওবাহর নামায পড়তে পারেন।
(১৫) তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ নামায একই। আর রমযানে এশার পরেই পড়া উত্তম। সুতরাং, দুই দুই রাকাত করে বিতিরসহ মোট ১১ বা ১৩ রাকাত তারাবীহর নামায পড়বেন, এটাই উত্তম ও যথেষ্ঠ। তবে কেউ অতিরিক্ত পড়তে চাইলে নিষিদ্ধ নয়।
(১৬) আরো যত সুন্নতী যিকির আযকার আছে, করার চেষ্টা করবেন ইন শা আল্লাহ।
লাইলাতুল কদরের বিশেষ দুয়াঃ
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে তখন কোন দুয়াটি পাঠ করব? তিনি বললেন, তুমি বলঃ “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন তুহিব্বুল্ আফওয়া ফাঅ’ফু আন্নী।”
অর্থঃ হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে তুমি ভালোবাস। সুতরাং, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। মুসনাদে আহমদঃ ৬/১৮২।
শবে কদরের একটি রাতে এই রকম ইবাদতের মাধ্যমে আপনি ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদতের চাইতে বেশি সওয়াব অর্জন করতে পারেন। ইবাদতের এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাত ছাড়া না হয়। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।
_____________________________
লাইলাতুল ক্বদর কত তারিখে?
(১) শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ তাঁর “রমযান মাসের ৩০ আসর” নামক বইয়ে লিখেছেন,
“লাইলাতুল ক্বদর রমযান মাসের শেষ সাত দিনের মধ্যে (২৩-৩০) যেকোন এক দিনে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা, আব্দুল্লাহ ইবন উ’মার রাদিয়াল্লাহু আ’নহুমা থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কতিপয় সাহাবী রমযানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল ক্বদর স্বপ্নে দেখেছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি যে তোমাদের সবার স্বপ্ন শেষ সাত দিনের ব্যাপারে এসে একাত্মতা ঘোষণা করছে। সুতরাং, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতকে নির্দিষ্ট করতে চায়, সে যেন শেষ সাত দিনের মধ্যে তা নির্ধারণ করে।” সহীহ বুখারীঃ ২০১৫, সহীহ মুসলিমঃ ১১৬৫।
অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমের হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা রমযানের শেষ দশ রাতে লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ কর। যদি তোমাদের কেউ দুর্বল থাকে অথবা অক্ষম হয়, তাহলে সে যেন শেষ সাত রাতে সেটা খুঁজতে অপারগ না হয়।” সহীহ মুসলিমঃ ১১৯৫।
আর শেষ সাত দিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে ২৭-তম রাত্রিটিই লাইলাতুল ক্বদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ উবাই ইবন কাআ’ব রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেছেন, “আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই সে রাতটিকে জানি, যে রাতটিতে কিয়াম করার (নামায পড়ার) জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন। আর তা হচ্ছে, রমযানের ২৭-তম রাত।” সহীহ মুসলিমঃ ৭৬২।
(২) শায়খ মুহাম্মাদ নাসির উদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর “তারাবীহ ও ইতিকাফ” নামক বইয়ে লিখেছেন, “সবচাইতে অগ্রগণ্য মত অনুযায়ী ২৭শে রমযানের রাত্রিই হচ্ছে লাইলাতুল ক্বদর।” তাঁর এই মতের পক্ষে তিনি দলিল হিসেবে নীচের এই হাদীসটিকে পেশ করেছেন।
উবাই ইবনে কাআ’ব রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেছেন, “যিনি ছাড়া আর কোন (সত্য) উপাস্য নেই, সেই সত্ত্বার কসম! লাইলাতুল ক্বদর রমযান মাসেই লুক্কায়িত রয়েছ। (এ কথা বলার সময়) তিনি ইন শা আল্লাহ না বলেই কসম করলেন। তারপর বললেন, আল্লাহর কসম! সেটি কোন রাত? আমি অবশ্যই সেই রাতটিকে জানি। লাইলাতুল ক্বদর হচ্ছে সেই রাত, যে রাতে নামায পড়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর তা হচ্ছে, ২৭শে রমযানের রাত। লাইলাতুল ক্বদরের নিদর্শন হচ্ছেঃ ঐ রাত শেষে সকালে সূর্য এমন পরিষ্কারভাবে উঠবে যে, তাঁর কোন কিরণ থাকবেনা।”
অন্য একটি বর্ণনায় এটিকে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ‘মারফূ’ সূত্রে বর্ণনা করছেন।
সহীহ মুসলিমঃ ৭৬২, আবু দাউদঃ ১৩৭৮, মিশকাতঃ ২০৮৮, সহীহ আবু দাউদঃ ১২৪৭।
___________________★★★★★____________________