আমরা কত সহজেই একজন অ্যাপারেন্টলি নন প্র্যাকটিসিং মুসলিমকে খোঁচা মেরে কথা বলি। তাদেরকে নিয়ে ট্রল বানাই। হিজাবি গার্লফ্রেন্ড, নামাজী বয়ফ্রেন্ড, এগুলো নিয়ে কম হাসাহাসি হয় না অনলাইনে বা অফলাইনে। খোঁচা মেরে আর যাই হোক, দাওয়াহ বা ইসলাহ হয় না। স্পেশালি খোঁচা মারার উদ্দেশ্য যদি থাকে হাসি তামাশা করা। একবার আমরা নিজের দিকে তাকাই। কত দিন হল ৫ ওয়াক্ত সালাহ শুরু করেছি, ৫ বছর ১০ বছর? কতদিন হলে প্রপারলি হিজাবটা পরি আমি?
আমি অন্যান্যদের কথা জানিনা। নিজের জীবন দেখেছি, এই একটা জীবনই আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি। আমি ইসলামে আসার আগ পর্যন্ত জানতামই না যে প্রেম জিনিসটা হারাম। আমি এটাও জানতাম না যে সালাহ না পড়লে মানুষ মুসলিম থাকে না। এটাও জানতাম না যে হিজাব করাটা ফরজ। আসলে আমি ফরজের মানেই জানতাম না। ফরজ তরক করলে যে গুনাহ হয় এটা আমার জানা ছিল না। আমি নিজের ওই জীবনের কথা চিন্তা করি, একটু একটু মাথায় কাপড় দেই, ভাল লাগে এই জন্য। ওই সময় আমার এক কাজিন এসে আমাকে বলল,
“কিরে তুই সিজনাল পর্দা করিস নাকি?”
আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি শ্রেফ ভাল লাগা থেকে মাঝে মাঝে বোরকা পরতাম। চেষ্টা করতাম কন্টিনিউ করার, শ্রেফ পোষাকটার প্রতি ভাল লাগা থেকে। আমাকে কেউ বলেনি যে ফুল ভেইল না করলে গুনাহ হবে। উল্টো আমাকে শুনতে হল আমি সিজনাল পর্দা করি নাকি। মনটা খুব ছোট হয়ে গিয়েছিল।
এক ছোট বোন যখন ইসলামের দিকে আসছিল তার তখন অ্যাফেয়ার ছিল। একটা লেকচারে শুনেছিলাম,আনফরচুনেটলি আমরা যখন এসব অ্যাফেয়ার ছাড়ার জন্য দাওয়াহ দেই এমনভাবে দেই যেন আমরা ঝুড়ি ভরা কয়লা নিয়ে ডিল করছি। আমাদের মাথায় এটা থাকে না এটা একটা ইমোশনাল ব্যপার , আমরা আসলে হার্ট নিয়ে ডিল করছি। তো আপুটা নিজে সালাহ শুরু করে তার অপরজনকেও উঠতে বসতে তাগাদা দিতে থাকে সালাহ পড়ার জন্য। দেখা করা বন্ধ করে দেয়। ফোনে কথা বলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়ে যায় সবকিছু। এদিকে গুনাহ হয়ে যাচ্ছে সেই অপরাধবোধ অন্যদিকে মনকেও মানাতে পারছেনা। বছরে একবার দেখা করতে গেলেও বোনটা অপরজনকে বলত আপনি সামনে হাঁটেন, আমি পেছনে হাঁটছি। অবশেষ বোনটার এরকম করে ইসলাম প্র্যাকটিস করাটা আরেকজন মেনে নিতে পারেনি। বোনটা বিয়ের জন্য রিকুয়েস্ট করেছিল, আরেকজন বলেছিল ২ বছর অপেক্ষা করতে। তা বোনটা বলেছিল ২ বছর কারও গার্ল ফ্রেন্ড ট্যাগ নিয়ে উনি বেঁচে থাকতে চান না। আলহামদুলিল্লাহ, ব্রেকাপ হয়েছিল।
আমি আসলে চিন্তা করি, ওই সময় বোনটা যখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিল কিভাবে গুনাহ মিনিমাইয করা যায় তখন আমরা যদি তার সামনে হিজাবি গার্লফ্রেন্ড টাইপ জোক করতাম কেমন লাগত উনার?
আমরা আসলে ভেবে দেখিনা যে, অন্তরের মত একটা কোমল জায়গা আসলে কথার তরবারির কতটুকু আঘাত সইতে পারবে।
এবার নিজের কথায় আসি। ২০০৭ সাল। আমি তখন ২০০% জাহেল। মাথায় ঘোমটার মত করে কাপড় দেই। মাঝে মধ্যে ৩-৪ ওয়াক্ত সালাহ পড়ি। আর মাঝে মাঝে এওটু একটু ক্বুর’আনের অর্থ পড়ি। ব্যাস। তখন অ্যাডমিশনের জন্য কোচিং করতে ঢাকায়। হঠাৎ খুবই অসুস্থ হয়ে যাই। আব্বু কয়েকদিন পর এসে কিছু পরীক্ষা করার জন্য একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গেলেন। রক্ত নেয়ার সময় হঠাৎ কি যেন হল, আমার মনে হল আমাই মারা যাচ্ছি, আমি জোরে জোরে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে শুরু করলাম, আর কালিমা পড়তে পড়তে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
কিন্তু পরবর্তী অনেক বছর আমি চিন্তা করেছি, আমি কেন আসলে ওই সময় কালেমা পড়েছিলেম। আচ্ছা আমি মরে যাচ্ছি এই অনুভূতি নিয়ে কালেমা পড়ার কি হল? আমি সবচেয়ে বেশি পড়তাম হচ্ছে আয়াতুল করসী। সেই হিসেবে আমার আয়াতুল কুরসী পড়ার কথা ছিল। আমি বহু বছর চিন্তা করেছি কেন আসলে আমি কালেমা পড়ছিলাম যখন বুঝে গেছি যে মারা যাব।
এখন আফসোস হয়, আচ্ছা ওইসময় যদি মারা যেতাম আমি নিশ্চিত জান্নাতে যেতাম! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যার শেষ কথা হবে লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
আমি খুব অবাক হই, জাহেলিয়াতের চূড়ায় থাকা অবস্থায় আমি যদি ওইদিন মারা যেতাম তাহলে আমি জান্নাতি হতাম! কি আশ্চর্য!
অথচ এখন নিজের দিকে তাকাই, কত জনের সমালোচনা করেছি, কত নন প্র্যাকটিসিং মানুষকে নিয়ে গীবাহ করেছি। নিজের যা কিছু আমল ছিল তা তাদের জন্যই বরাদ্দ করে দিয়েছি। এখন আমার কি অবস্থা হবে আমি জানিনা। এখন আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে আমার তা জানা নাই। এখনই যদি মারা যাই আমি জানিনা আমার শেষ কথাগুলো কি হবে।
আমার সেই কাজিনের কথা বলে শেষ করতে চাই। ও দিন দিন ইসলাম থেকে বহু দূরে সরে গেছে। অশালীন পোশাক পরা মেয়ে দেখলে যে মানুষ রাগে ফোঁশ ফোঁশ করতে করতে বলত, “আপা, ওর পেছনে একটা লাত্থি দিতে পারবি? ” আজ সেই মানুষটা যখন বিয়ের জন্য একই রকম মেয়ে পছন্দ করে তখন খুব কষ্ট লাগে। সেই সাথে ভয় লাগে। আমি নিজে যেন এরকম না হয়ে যাই।
আমরা যেন সুন্দর ভাবে দাওয়াহ করি। যেখানে কোমলতা দরকার সেখানে যেন কোমলতা দেখাই, যেখানে কঠরতা দরকার সেখানে যেন কঠোরতা দেখাই। কিন্তু কাউকে যেন বিদ্রুপ না করি। আজকে এই ভার্চুয়াল জগতে যেই সকল মুসলিম ভাই বোনকে আমরা বিদ্রুপ করছি, আমরা জানিনা কালের পরিক্রমায় হয়তো তাদেরকে আল্লাহ আমাদের উপরে মর্যাদা দিবেন আর হয়তো তারা সবচেয়ে বড় সমাবেশের দিন- ইয়াউমুল ক্বিয়ামাহতে আমাদেরকে বিদ্রুপ করবে।
আমার আনুরোধ। দাওয়াহ হোক ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ মুক্ত। সত্য এমনিতেই সুন্দর। এটাকে রঙ চং দেয়ার দরকার হয় না। যার ইচ্ছা একে গ্রহণ করুক। যার ইচ্ছা বর্জন করুক। কিন্তু আমাদের দেয়া রঙ চং যেন কারও অন্তরে কালি না লেপে দেয়।
আমরা যেন ভুলে না যাই- আর রাহমান- যিনি একজন পতিতাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন নাপাক জন্তু কুকুরকে পানি খাওয়ানোর জন্য তাঁর জন্য হিজাবি গার্লফ্রেন্ড বা নামাজী বয়ফ্রেন্ডকে ক্ষমা করা কোন ব্যপার না যাদের মাংস আমরা দেদারসে চিবিয়ে খাচ্ছি।
Courtesy: Sister Shabnaj Rafnee