ফাত্ওয়া কী ও কেন ?
ফাত্ওয়া কী ও কেন ?
লেখক:- ড. মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ
অনুলিখন: উমর
ফাত্ওয়া ও ফাতাওয়া শব্দ নিয়ে শংকা ও সংশয় তৈরি হয়েছে আমাদের একদল বুদ্ধিজীবীর মধ্যে। ফাত্ওয়া সম্পর্কে যথাযথ ধারনা না থাকার কারণেই মূলত: একদল পণ্ডিত (?) এ বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হচ্ছেন। সত্যিকথা হচ্ছে, একজন ঈমানদানর মুসলিমের অন্তরে ফাত্ওয়া নিয়ে সংশয় ও অনিহা থাকা ঈমানের দুর্বলতার পরিচায়ক। ফাত্ওয়া নিয়ে সংশয়, অনিহা ও উপহাসমূলক মন্তব্য করা ঈমান বিনষ্টকারী অপরাধের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। কেননা ফাত্ওয়া অহি নির্ভর জ্ঞান ও বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক মহান আল্লাহর নির্দেশিত বিধানের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’লা এভাবে বলেছেন :
قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ لا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ
“বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর নিদর্শনসমূহ ও তার রাসূলের সাথে উপহাস করছো? আর ওযর পেশ করোনা, এভাবে তোমরা ঈমানের পর কুফরিতে লিপ্ত হয়ে গেলে।” (সূরা আত্ তাওবাহ : ৬৫-৬৬)
পবিত্র কুরআনের এ আয়াত হতে আমরা স্পষ্ট ধারণা পাই, আল্লাহর আয়াত নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা বা উপহাসে লিপ্ত হওয়া, আল্লাহর বিধানকে তুচ্ছজ্ঞান করা ঈমানের ঘোষণা দেয়ার পর ঈমান বিধ্বংসী কুফরি কর্মের অন্তর্ভুক্ত। ফাত্ওয়া আল্লাহর বিধানের অপর নাম ও আল্লাহ তা’লার আয়াতসমূহ বাস্তবায়নের একটি রূপ। আমরা ফাত্ওয়া নিয়ে মৌলিক কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
ফাত্ওয়া কি?
ফাত্ওয়া বা ফাতাওয়া শব্দ দু’টি ইফতা ক্রিয়ামূল হতে, এ ক্রিয়ামূলের কর্ম-এর অর্থ হচ্ছে, বর্ণনা করা, পেশ করা, জানানো, সমাধান দেয়া। ইসলামী শরি’আহ বা ইসলামী আইনে এ শব্দটি একটি পরিভাষা। এর পারিভাষিক একটি অর্থ রয়েছে।
ইমাম কারাফী (রহ.) এ পরিভাষাটির পরিচয় এভাবে দিয়েছে : শরিয়তের বাধ্য-বাধ্যকতা, বৈধতা ও অবৈধতার ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের বিবরণ দেয়া হচ্ছে মূলত: ফাত্ওয়া। (আল ফুরুকু ৪/৫৩)
ইমাম ইবনুস সালাহ আল ইরাকী (রহ.) বলেন : ফাত্ওয়া হচ্ছে, মহিয়ান আল্লাহ তা’লার পক্ষ হতে তাঁর বিধান স্বাক্ষরিত করা ও বাস্তবায়ন করা। (আ-দাবুল মুফতিওয়াল মুস্তাফতি পৃ.-৭২)
ফাত্ওয়ার পারিভাষিক অর্থ থেকে আমরা স্পষ্ট করে বুঝতে পারলাম, ফাত্ওয়া হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার নির্ধারিত বিধান বিবৃত করা আল্লাহর বিধানের আলোকে মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান পেশ করা, আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা। তাই শরি’আহ আইনে ফাত্ওয়া বিষয়টি অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। ফাত্ওয়ার গুরুত্বের উপর কিছু কথা তুলে ধরা হলো :
ফাত্ওয়ার গুরুত্ব ও মর্যাদাঃ
১. ফাত্ওয়ার মৌলিক বিষয় হচ্ছে আল্লাহর বিধান। মানবতার ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ নিহিত রয়েছে এর মধ্যে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) বলেন : “যাতে মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিহিত আছে, যা অহির জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত।” (ই’লামুল মুয়াক্কিঈন ১/১১)
২. এতে মূলত: ইসলামী জ্ঞানের সম্প্রসার ও মানুষের আমলের সংশোধন নিহিত আছে। (আত্ তামহীদলিম আসনাবী পৃ. ৫০৯)
৩. ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) ফাত্ওয়া বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই তিনি এ কাজকে আল্লাহ তা’লার পক্ষ হতে তার বিধানের তাত্তকী বা স্বাক্ষর করা বা বাস্তবায়ন করাকে বুঝিয়েছেন। তিনি ফাত্ওয়ার একাজকে মর্যাদাপূর্ণ কাজ, এমনকি পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ বিষয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। (ই’ঈলামুল মুয়াক্কিঈন ১/১০)
৪. হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ফাত্ওয়ার বিভ্রাটকে চরম বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন; এতে মানুষ হেদায়েত থেকে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়। (হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহ.) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস হতে বর্ণনা করেছেন।)
৫. ফাত্ওয়ার দ্বীনের সংস্কার ও সংশোধনের মর্যাদা রক্ষা করে যুগে যুগে মানবিক দুর্বলতার কারণে ইসলামী আইনে যে সব বিষয়ে প্রচ্ছন্নতা সৃষ্টি হয় তা ফাত্ওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ লাভ করে এবং এতে পরিবেশের বেড়াজালে দিশেহারা মানবতা ইসলামের স্বচ্ছ ও সুন্দর প্রবাহে অবগাহন করতে পারে।
মহান আল্লাহ ফাত্ওয়াকে নিজের সাথে সম্পর্কিত করেছেনঃ
পবিত্র কুরআনের সূরা আন নিসার ১২৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন :
“লোকেরা আপনার কাছে নারীদের প্রসঙ্গে ফাত্ওয়া চায়, আপনি বলুন, আল্লাহ তাদের ব্যাপারে তোমাদের ফাত্ওয়া দিচ্ছেন এবং সে বিষয়েও যা কিতাবে তোমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে ।” (সূরা আন নিসার ১৭৬ নং আয়াতেও মহান আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে স্পষ্ট করে বলেছেন :
“লোকেরা আপনার নিকট ফাত্ওয়া জানতে চায়, আপনি বলুন, পিতা-মাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদেরকে ফাত্ওয়া দিচ্ছেন” পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াত থেকে প্রমাণিত হলো ফাতাওয়াকে মহিয়ান আল্লাহ তা’লা তার মহান সত্ত্বার সাথে সম্পর্কিত করেছেন এবং ফাত্ওয়া দানের মহান কাজটি তাঁর মোবারক কর্মসমূহের একটি, এ কথাটিও আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) বলেন : এটি এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ পদ যা অধিকৃত করেছেন বিশ্বজাহানের প্রতিপালক নিজেই। (ই’ঈলামুল মুয়াক্কিঈন ১/১১) এতে প্রমাণিত হয়েছে সর্বপ্রথম ফাত্ওয়া আল্লাহ তা’আলা নিজেই দিয়েছেন। তাই এ বিষয়টি উপহাস ও বিদ্রুপের বিষয় নয়।
বিশ্বনবী (সা.) নিজেও ফাত্ওয়া দিয়েছেনঃ
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) এ উম্মাতের মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম এ মহান কাজটি করেছেন তিনি হলেন, সাইয়্যেদুল মুরসালিন, ইমামুল মুত্তাকীন, খাতামুন নাবীয়ীন, আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল, অহির আমানতদার, বান্দাহ ও আল্লাহর মাঝে যোগসূত্র সৃষ্টিকারী বার্তাবাহক মুহাম্মদ (সা.)। এ কারণে মহান আল্লাহ তাঁকে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন : তিনি বলেন, “তবে এটাই সত্য, আর আমি সত্য বলি, আর বলুন, আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোন প্রতিদিন চাই না; আর আমি মিথ্যা দাবীদারদের অন্তর্ভুক্ত নই।” (সূরা সাদ ৮৪, ৮৬)
নবী (সা.) এর সকল ফাত্ওয়াই ছিল আল্লাহর বিধান ও মানব জীবনের সুস্পষ্ট ফয়সালা সম্বলিত। (ই’ঈলামুল মুয়াক্কিঈন ১/১১) নবী (সা.) আরও বলেন : আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। ইমাম নববী (রহ.) বলেন : শিক্ষক হিসেবে তার অন্যতম দায়িত্ব ছিল আল্লাহর বিধানসমূহ গুরুত্বসহকারে মানুষদের জানিয়ে দেয়া। মূলত: ফাত্ওয়ার মৌলিক বিষয়ও এটিই। উপরোক্ত বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে ফাত্ওয়া। কোনভাবেই একাজটি অবজ্ঞা করার অবকাশ একজন মুসলমানের নেই। এ উম্মাতের শ্রেষ্ঠ মানুষ সাহাবীরা ফাত্ওয়া দিয়েছেন। রাসূল (সা.) এর ইনতিকালের পরে তার সাহাবীরা ফাত্ওয়ার এ মর্যাদাপূর্ণ কাজটি আঞ্জাম দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সাহাবীরা কার্পণ্য প্রদর্শন করেন নি বা পিছপা হননি। আব্দুল রহমান ইবনে আবি লাইলা (রহ.) বর্ণনা করেন এবং আমি এ মসজিদে অর্থাৎ নবী (সা.) এর মসজিদে-১২০ এর অধিক সাহাবীকে পেয়েছি যারা এখানে বসে মানুষদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন বা ফাত্ওয়া দিতেন।” (সুনান আদ্দারেমী ১/৫৩, জামে বায়ানিল ইল্মি ও ফাদলিহি ১/১৭৭) সহীহ হাদীসের বর্ণনায় এসেছে, উমার ইবন আলখাত্তাব (রা.) যখন খিলাফতের দায়িত্বে ছিলেন, জটিল-জটিল বিষয়ে সমাধানের জন্য প্রসিদ্ধ সাহাবীদের একত্রিত করে জিজ্ঞাসা করতেন। এ ঘটনা থেকে সাহাবীদের মাঝে ফাত্ওয়া বোর্ডের স্বরূপ ফুটে ওঠে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সঠিক সমাধান লাভ করার জন্য মুসলিম উম্মাহর জন্য ফাত্ওয়া বোর্ড থাকাটা কল্যাণকর ও শরীয়া সমর্থিত বিষয়।
ফাত্ওয়া নেক আমল বা পূণ্যের কাজঃ
ফাত্ওয়া পূণ্যকাজের একটি। এতে ফাত্ওয়া দানকারী মুফতির জন্য প্রতিদান বা সাওয়াব রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত: রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন: “না জেনে কাউকে ফাত্ওয়া দিলে তার পাপ ফাত্ওয়া প্রদানকারীদের উপর বর্তাবে, যে ব্যক্তি তার ভাইকে কোন বিষয়ে পরামর্শ দিল অথচ সে জানে এতে তার জন্য কল্যাণ ও সফলতা নেই তাহলে সে তার সাথে খেয়ানত করল।” (আবু দাউদ ৩৬৫৭ হাদীসটি উত্তম সনদে বর্ণিত] এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, ব্যক্তি জ্ঞানদীপ্ত হয়ে, এবং আল্লাহর বিধান সম্পর্কে জেনে ফাত্ওয়া দেবেন তার জন্য আল্লাহ তা’লার পক্ষ হতে প্রতিদান রয়েছে।’ সুতরাং এটি অন্যতম একটি নেকআমল, যার মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাহ নিজের ও অন্য মানুষদের কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হয়। বিপর্যয় ও বিভ্রান্তির পথ থেকে মানুষদের রক্ষা করতে পারে।
ফাত্ওয়ার শরীয় মর্যাদাঃ
ফাত্ওয়া বিষয়টি ইসলামী শরীয়াতে ক্ষুদ্র বিষয় হিসেবে দেখা হয়নি বরং যেহেতু এটি আল্লাহর বিধানের বর্ণনা ও আল্লাহর বিধানের আলোকে সমাধানের বিষয়, সেহেতু এর মর্যাদাও শরীয়তে অনেক। এর বিধান প্রসঙ্গে উলামায়ে কিরাম বলেন : ফাত্ওয়ার হুকুম হচ্ছে, ওয়াজিব আলাল কিফায়াহ। অর্থাৎ এ কাজটি সামগ্রিক ওয়াজিবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, একদল লোক পালন করার মাধ্যমে এর দায়িত্ব থেকে অন্যরা অব্যহতি পাবে, তবে কেউ দায়িত্ব পালন না করলে সবার সমানভাবে গুণাহ হবে। (ইমাম সুয়ুতী (রহ.) আদাবুল ফুত্ইয়া পৃ.-৯৩) গ্রন্থে উল্লেখ করেন : যার কাছে ফাত্ওয়া দেওয়ার মত যোগ্যতা আছে তার উপর ফাত্ওয়া দেয়া ওয়াজিব বা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে ফাত্ওয়া দিয়ে বিনিময় গ্রহন করা হারাম। ইমাম বুখারী ও মুসলিম আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : লোকেরা বলাবলি করছে যে, আবু হুরাইয়া অনেক বেশী বর্ণনা করেছে, অথচ আমি বলছি আল্লাহর কিতাবের এ দু’টি আয়াত, যদি আমি না জানতাম তা হলে আমি মোটেও হাদীস বর্ণনা করতাম না।
আল্লাহর কিতাবের আয়াত দু’টি হচ্ছে, “নিশ্চয়ই আমরা যেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ নির্দেশনা অবতীর্ণ করেছি মানুষের জন্যে কিতাবে, তা স্পষ্ট করে ব্যক্ত করার পরও যারা এসব গোপন রাখে আল্লাহ তাদেরকে লানত দেন এবং অভিশাপকারীগণও তাদের প্রতি অভিশাপ দিয়ে থাকে। কিন্তু যারা তওবা করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে আর সত্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে এরাই ঐসব লোক যাদের তাওবা আমি কবুল করি আর আমি অতিশয় তাওবা গ্রহণকারী পরম দয়ালু।” (সূরা আল বাকারাহ ১৫৯-১৬০)
ফাত্ওয়া ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে কুরআন কারীমের নিম্নোক্ত আয়াতটিও দলিল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আল্লাহ তা’লা বলেন :
“আর যখন আল্লাহ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন তাদের কাছ থেকে যাদেরকে কিতাব দেয়া হল, তোমরা তা অবশ্যই মানুষের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করবে এবং তা গোপন করবে না; এরপর তারা তা তাদের পৃষ্টদেশের পেছনে নিক্ষেপ করে অগ্রাহ্য করে ও তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে, সুতরাং তারা যা ক্রয় করে তা কতইনা নিকৃষ্ট।” (সূরা আলে ইমরান : ১৮৭)
প্রসঙ্গত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সে হাদীসটিও এখানে স্মরণ করা যায় যাতে তিনি ফাত্ওয়া গোপন করার ভয়ানক পরিণতি তুলে ধরেছেন। আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যাকে জ্ঞান সম্পর্কিত কোন বিষয় জিজ্ঞেস করা হয় আর সে তা গোপন করে আল্লাহ তা’লা কিয়ামতের দিন তার মুখে জাহান্নামের আগুন থেকে প্রস্তুতকৃত লাগাম পরিয়ে দিবেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভয়াবহ শাস্তি, যিনি ফাত্ওয়া গোপন করবেন তার জন্যে।
এ বিষয়ে অনেক আয়াত ও হাদীস রয়েছে। আমরা উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি উল্লেখ করলাম। যা প্রমাণ করে ফাত্ওয়ার এ কাজটি মুসলিম উম্মাহর আলেমদের উপর অর্পিত দায়িত্ব, এর থেকে বাঁচার উপায় আলেমদের নেই।
ফাত্ওয়ার শরীয় মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্যে রাসূল (সা.) এর এ হাদীসটি প্রকৃষ্ট দলীল। আবু রিফাআহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলা হয়েছে, অপরিচিত এক ব্যক্তি এসেছে, সে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চায়, সে তার দ্বীন সম্পর্কে কিছুই জানে না। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) খোতবা বন্ধ করে দিলেন এবং ঐ আগুন্তক লোকটির কাছে গেলেন। রাসূলুল্লাহর (সা.) জন্য চেয়ার আনা হল, তিনি চেয়ারে উপবেশন করলেন। তারপর লোকটির প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ইসলাম সম্পর্কে জানালেন। এরপর ফিরে এসে খোতবা সম্পন্ন করলেন। (সহীহ মুসলিম : ৪৭৬)
ফাত্ওয়া নিয়ে এত বিভ্রাট ও বিবাদ কেন?
ইতোমধ্যে আমাদের সমাজ তথা বাংলাদেশে ফাত্ওয়া নিয়ে একটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি গড়াতে গড়াতে আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছে। মূলত: বিষয়টি আদালতের সাথে সম্পৃক্ত নয়, যেহেতু এ বিষয়টি জুডিশিয়াল ব্যাপার নয়। ফাত্ওয়া নিয়ে এ বিভ্রাট ও বিবাদের কারণ হচ্ছে, দু’টি:
ফাত্ওয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও ধারণা না থাকাঃ
ফাত্ওয়া সম্পর্কে অনেকের ধারণা হচ্ছে, ফাত্ওয়া মানবেতর বর্বর আইন, নির্যাতন ও শোষণের অপরনাম, নারী নির্যাতনের হাতিয়ার ইত্যাদি। ফাত্ওয়া সম্পর্কে এমন ভুল ধারণার কারণে অনেকে অনেক ভুল কথা বলছেন। ফাত্ওয়া সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। ফাত্ওয়া আল্লাহর বিধানের বিবরণ। ফাত্ওয়া কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানবতার জন্য ইসলামী আইনের স্বরূপ। ফাত্ওয়া মানুষের মূর্ত ও বিমূর্ত দিকগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তনের সহায়ক। ফাত্ওয়া মানুষের অন্তরের কলুষতা ও প্রচ্ছন্নতাকে দূর করে এবং আলোকিত করে। ফাত্ওয়ার নৈতিক প্রভাবেই মূলত: মানুষ মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পায়।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে আসে। মানুষ কেন ফাত্ওয়ার দ্বারস্থ হয় অথবা ফাত্ওয়া জানার জন্য চেষ্টা করে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ফাত্ওয়ার প্রতি মানুষের অনুরাগ, প্রবল আস্থা ও আন্তরিক বিশ্বাসই তাদেরকে ফাত্ওয়া জানতে ও ফাত্ওয়া মানতে উদ্বুদ্ধ করে। ফাত্ওয়া জানা ও মানার জন্য কোন মহল থেকে বাধ্য-বাধকতা বা চাপা-চাপি নেই। ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কখনো ঈমান ও বিশ্বাসের তাকিদে, কখনো মানসিক প্রশান্তির তাকিদে ফাত্ওয়া জানা ও মানার চেষ্টা করে। পৃথিবীতে এমন কোন আইন নেই যার প্রতি মানুষের এ ধরনের শ্রদ্ধাবোধ, মূল্যবোধ ও অনুশীলন স্পৃহা রয়েছে। ফাত্ওয়ার এ প্রেক্ষাপট প্রমাণ করে মানব জীবন, বিশেষ করে ঈমানী জেন্দেগীতে এর কতটুকু ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
ফাত্ওয়ার অপব্যহার ও অপপ্রয়োগের সুযোগঃ
ফাত্ওয়ার অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর বুদ্ধিবীজী ও শিক্ষিত মহল ফাত্ওয়ার প্রতি বিষদাগার করছেন। তাদের ধারণা ফাত্ওয়ার কারণেই এসব সামাজিক অঘটন ঘটেছে। তাই তারা কোন ধরনের বুঝ-বিবেচনা না করেই ফাত্ওয়াকে নানা সমস্যার জন্য দায়ী করে যাচ্ছেন। এসব বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতি আমাদের সবিনয় প্রশ্ন, আইন মানুষের কল্যাণের জন্য, অনুরূপ ফাত্ওয়াও মানুষের কল্যাণের জন্য। আইনের অপপ্রয়োগের কারণে অথবা আইনের অস্পষ্টতার কারণে কোন বিবেকবান ব্যক্তি কি আইন বাতিল করতে এ পর্যন্ত সুপারিশ করেছে? কোন ব্যক্তি যদি আইনকে হাতে তুলে নেয়, আইনের নাম দিয়ে নিরীহ ও নির্বোধ মানুষদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়িন চালায় এতে কি আদালত আইনকে দায়ী করবে? কোন অতিউৎসাহী, সুযোগ সন্ধানী অথবা কায়েমী স্বার্থবাদী যদি ফাত্ওয়া বাস্তবায়নের নামে সামাজিক অনাচার চালায়, তাতে ফাত্ওয়া ঐ ব্যক্তির কারণে কতটুকু দায়ী হবে? এ পরিস্থিতিতে ফাত্ওয়াকে দায়ী করে ফাত্ওয়া বাতিল করা বা ফাত্ওয়া নিষিদ্ধ করা কতটুকু আইন সম্মত ও যুক্তিনির্ভর হবে আমরা বিবেকবান মহলের কাছে তা জানতে চাই।
মূলত: ফাত্ওয়ার বিবরণ ও প্রয়োগ দু’টিই মানুষের ইখতিয়ারের বিয়ষ। কোনভাবেই ফাত্ওয়াকে দোষারোপ করার বিবেক সম্মত নৈতিক ভিত্তি নেই। কেবল প্রবৃত্তির অনুসরণ ও অন্তরের বিদ্বেষ দিয়েই ফাত্ওয়ার বিরুদ্ধে বিবাদে লিপ্ত হওয়া যায়। ফাত্ওয়া মুসলিম উম্মাহর অনুভূতি, আবেগ ও ধর্মীয় চেতনার সাথে সম্পৃক্ত আমরা আগেই বলেছি ফাত্ওয়ার সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা এবং আবেগও অনুভূতির নিকটতম অবস্থান রয়েছে। মুসলমানরা তাদের ইবাদাতের ক্ষেত্রে যেভাবে প্রতিনিয়ত ফাত্ওয়ার কাছে প্রত্যাবর্তিত হয়, তেমনিভাবে তারা নিজেদের মোআমালাত বা লেনদেন, আচার-আচরণের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও আবেগের সাথে ফাত্ওয়ার কাছে ফিরে যায়। এর প্রকৃত ভিত্তি হচ্ছে, তাদের ঈমান ও আখেরাতের জবাব দিহিতা। সুতরাং মুসলমানদের এ অনুভূতি ও চেতনায় আঘাত হানা কতটুকু নীতিসঙ্গত এবং আধুনিক আইন সমর্থিত? প্রশ্নটি বিবেকের কাছে তুলে ধরা যায়।
ফাত্ওয়া জুডিশিয়াল রায় বা দণ্ডবিধি বা শাস্তির ঘোষণা নয়ঃ
আমাদের মাঝে কারো কারো এ চিন্তা আসতে পারে যে ফাত্ওয়া জুডিশিয়াল অর্ডারের মত বিষয় অথবা দণ্ডাবিধির ঘোষণা। মূলত: ব্যাপারটি এমন নয়। মানবজীবনের কোন না কোন ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান তুলে ধরা হচ্ছে ফাত্ওয়া। এ ফাত্ওয়া যিনি দিয়ে থাকেন তাকে মুফতি বলা হয়। ইসলামী শরীয়াতে মুফতির জুডিশিয়াল রায় দেয়ার অধিকার সংরতি নেই। তাই ফাত্ওয়া নির্ভর যত ঘটনা ঘটেছে, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাথে ফাত্ওয়ার কোন প্রকার সম্পৃক্ততা নেই। আমরা একটু বিবেচনা করলে দেখব, যারা এসব ঘটিয়েছে তারা কোন না কোন ইনটেনশন রেখেই এসব করেছে। তাই এর জন্য কোন মুফতিকে দায়ী করা আইনের দৃষ্টিতে মোটেও গ্রাহ্য নয়। আইনের বই পড়ে কোন আইনজ্ঞ যদি কাউকে আইনের বিষয় অবহিত করেন, তাতে তিনি দোষী হবেন কোন যুক্তিতে?
ফাত্ওয়ার বিরোধীতা ইসলামের বিপক্ষে কঠোর অবস্থানঃ
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি, ফাত্ওয়ার বিরোধীতা নীতি-নির্ভর বা যুক্তিনির্ভর বিষয় নয়, তারপরও এর বিরোধীতা কেন? একটিই এর উত্তর হতে পারে। আর তা হচ্ছে, ইসলামের বিরোধীতা করার জন্যই ফাত্ওয়ার বিরোধীতা। মূলত: যারা ফাত্ওয়ার বিরোধীতা করেছেন তাদের কাছে নীতি-নৈতিকতা, আইন ও যুক্তি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে তারা অন্তরে যা গোপন রেখে দিচ্ছে। ফাত্ওয়ার বিরোধীতার আড়ালে তাদের ইনটেনশন বা মনের কথাই মূল। বিষয়টি আল্লাহ তাআলা আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। সূরা আলে ইমরানের ১১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “তারা কামনা করে এমন বিষয় যা তোমাদের বিপন্ন করে, তাদের মৌখিক বক্তব্য থেকেই বিদ্বেষ প্রকাশ পায়, আর তারা অন্তরে যা গোপন রাখে তা আরও জঘন্য। আমরা তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি, যদি তোমরা তা অনুধাবন কর।” ফাত্ওয়ার বিরুদ্ধে এ ধরনের অবস্থানকে মূল্যায়ন করার মত কোন যুক্তি আমরা দেখিনি। তাই আমরা অনুরোধ জানাব, প্রবৃত্তি তাড়িত না হয়ে সুস্থ বিবেক দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করলে সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে।
একটি অনুরোধঃ
সর্বশেষে মাননীয় আদালতসহ আমাদের আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী মহল এবং সকল সুশীল সমাজের কাছে আমরা অনুরোধ করবো, ইসলাম মানুষের মাঝে যে নৈতিকতাবোধ, মূল্যবোধ ও অপরাবোধ ও সচেনতা সৃষ্টি করতে পেরেছে তার অন্যতম মৌলিক সহকারী শক্তি হচ্ছে ফাত্ওয়া। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রবর্তিত, তিনিই প্রথম মুফতি, তারপর বিশ্বনবী (সা.) ফাত্ওয়া দিয়েছেন তাই এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার আগে একটি বিবেচনা করুন, ভেবে দেখুন আপনি কি স্বীয় ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন কিনা? ফাত্ওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর বিধানের বিপক্ষে কিছুই করতে পারবনা, কিন্তু একজন ঈমানদার-মুসলমান হিসেবে আমি নিজেই বিপর্যস্ত হব, হব পথহারা ও সত্যবিচ্যুত দিশেহারা।
লেখকঃ এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, আই আই ইউসি
Ph.D. in Islamic Shariah from Islamic University of Madinah Munawarah, Saudi Arab.
সা. = সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রা. = রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু
রহ.= রহিমাহুল্লাহ
***{সৌজন্যেঃ- Way To Jannah Website}***