তিন শ্রেণীর মুছল্লী জাহান্নামে যাবে
যহূর বিন ওছমান
আওলিয়াপুকুর ফাযিল মাদরাসা, চিরির বন্দর, দিনাজপুর।
ছালাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদত। এ ইবাদত কবুল হওয়ার উপরেই অন্যান্য ইবাদত নির্ভর করে। অথচ মানুষ ছালাতের যথার্থ গুরুত্ব অনুধাবন না করে যেনতেনভাবে ছালাত আদায় করে। এ ধরনের ছালাত আল্লাহর নিকটে কবুল হবে না; বরং এসব ছালাত আদায়কারীর জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে সে বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে।
ছালাত আদায়কারী তিন শ্রেণীর মানুষকে জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে। প্রথমতঃ যারা অলসতা বা অবহেলা বশতঃ সঠিক সময়ে ছালাত আদায় করে না। তাদের ছালাত কবুল হবে না। তাদের জন্য পরকালে শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّيْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ ‘অতঃপর দুর্ভোগ ঐসব মুছল্লীর জন্য, যারা তাদের ছালাত থেকে উদাসীন’ (মাঊন ১০৭/৪-৫)। অর্থাৎ لاهون عن الصلوة ويتغافلون عنها ‘যারা ছালাত থেকে উদাসীন ও খেল-তামাশায় ব্যস্ত’। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আউয়াল ওয়াক্ত ছেড়ে যঈফ ওয়াক্তে ছালাত আদায় করে। যারা জানা সত্ত্বেও ছহীহ হাদীছ মোতাবেক ছালাত আদায় করে না। রুকূ-সিজদা, উঠা-বসা যথাযথভাবে করে না। ক্বিরাআত ও দো‘আ-দরূদ ঠিকমত পাঠ করে না। কোন কিছুর অর্থ বুঝে না বা বুঝবার চেষ্টাও করে না। আযান শোনার পরেও যারা অলসতাবশে ছালাতে দেরী করে বা জামা‘আতে হাযির হওয়া থেকে বিরত থাকে। ছালাতে দাঁড়াবার সময় বা ছালাতে দাঁড়িয়েও অমনোযোগী থাকে ইত্যাদি।[1]
সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, এর অর্থ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الَّذِيْنَ يُؤَخِّرُوْنَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا، تَهَاوُنًا بِهَا- ‘যারা অবহেলা বশে সঠিক সময় থেকে দেরীতে ছালাত আদায় করে’।[2]
ইবনু কাছীর বলেন, عَنْ صَلَوتِهِمْ سَاهُوْنَ ‘তারা তাদের ছালাত থেকে উদাসীন’ অর্থ হ’ল তারা নিয়মিতভাবে বা অধিকাংশ সময়ে আউয়াল ওয়াক্তের বদলে আখেরী ওয়াক্তে ছালাত আদায় করে (ইবনু কাছীর)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَىِ الشَّيْطَانِ قَامَ فَنَقَرَهَا أَرْبَعًا لاَ يَذْكُرُ اللهَ فِيهَا إِلاَّ قَلِيلاً ‘ওটা মুনাফিকদের ছালাত, যারা সূর্যের প্রতীক্ষায় বসে থাকে, তারপর সূর্য অস্ত যেতে শুরু করলে শয়তান তার শিং মেলিয়ে দেয়, তখন তারা দাঁড়িয়ে মোরগের মত চারটি ঠোকর মারে। তাতে আল্লাহর স্মরণ খুব কমই হয়’।[3]
প্রকাশ থাকে যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ ছালাত আদায়কারী মুসলিম জানেন যে, ছালাত ফরয। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ছালাত আদায় করাও যে ফরয এটা অনেকেই জানে না। এ কারণেই বলা হয়েছে যে, ছালাত আদায় করেও তিন শ্রেণীর মুছল্লী জাহান্নামে যাবে। মহান আল্লাহ ছালাত ফরয করার পর বলেছেন,إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ كِتَابًا مَوْقُوْتًا- ‘নিশ্চয়ই ছালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত হয়েছে’ (নিসা ৪/১০৩)।
সময়মত ছালাত আদায় করা অন্যতম উত্তম আমল। নিম্নের হাদীছটি যার প্রমাণ, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
سَأَلْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم أَىُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ قَالَ الصَّلاَةُ عَلَى وَقْتِهَا. قَالَ ثُمَّ أَىُّ قَالَ ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ. قَالَ ثُمَّ أَىُّ قَالَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللهِ.
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, যথাসময়ে ছালাত সম্পাদন করা। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কোনটি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা’।[4] অন্য হাদীছে এসেছে উম্মে ফারওয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَىُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ قَالَ الصَّلاَةُ فِىْ أَوَّلِ وَقْتِهَا. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, আমল সমূহের মধ্যে কোন আমল সর্বাধিক উত্তম? তিনি বললেন, আউয়াল (প্রথম) ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা’।[5]
উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহর নিকট প্রিয় ও শ্রেষ্ঠতর আমল হচ্ছে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসলিম ছালাত আদায় করে শেষ ওয়াক্তে। উপরের দু’টি ছহীহ হাদীছ মাযহাবী আলেমগণ মুছল্লীদের সামনে পেশ করে না। তারা শুধু বড় জামা‘আতে বেশী ফযীলত এই ধোঁকা দিয়ে মানুষকে মুনাফিকদের ছালাত শিক্ষা দেয়। আর নেতারা শেষ সময় ছালাত আদায় করলে করণীয় সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন,
كَيْفَ أَنْتَ إِذَا كَانَتْ عَلَيْكَ أُمَرَاءُ يُؤَخِّرُوْنَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا أَوْ يُمِيْتُوْنَ الصَّلاَةَ عَنْ وَقْتِهَا. قَالَ قُلْتُ فَمَا تَأْمُرُنِىْ قَالَ صَلِّ الصَّلاَةَ لِوَقْتِهَا فَإِنْ أَدْرَكْتَهَا مَعَهُمْ فَصَلِّ فَإِنَّهَا لَكَ نَافِلَةٌ.
‘নেতারা যখন ছালাতকে তার ওয়াক্ত থেকে দেরী করে পড়বে বা ছালাতকে তার ওয়াক্ত থেকে মেরে ফেলবে তখন তুমি কি করবে? আমি বললাম, আপনি আমাকে কি করতে আদেশ করছেন? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ছালাতের ওয়াক্তেই ছালাত আদায় করে নিবে। অতঃপর তাদের সাথে যদি পুনরায় আদায় করতে পার তাহ’লে আদায় করবে। আর তা তোমার জন্য নফল হবে’।[6]
প্রকাশ থাকে যে, বড় জামা‘আতে ছালাত আদায় করার চেয়ে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা উত্তম। কারণ ছালাতের শেষ ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা মুনাফিকী। অতএব দেরিতে ছালাত আদায় করলে মুনাফিক হয়ে জাহান্নামে জ্বলতে হবে। আউয়াল ওয়াক্তে একাই ছালাত আদায়কারী ব্যক্তির প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিশেষ ক্ষমা রয়েছে। উক্ববা ইবনে আমের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَعْجَبُ رَبُّكُمْ مِنْ رَاعِى غَنَمٍ فِىْ رَأْسِ شَظِيَّةٍ بِجَبَلٍ يُؤَذِّنُ بِالصَّلاَةِ وَيُصَلِّى فَيَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ انْظُرُوْا إِلَى عَبْدِىْ هَذَا يُؤَذِّنُ وَيُقِيْمُ الصَّلاَةَ يَخَافُ مِنِّى فَقَدْ غَفَرْتُ لِعَبْدِىْ وَأَدْخَلْتُهُ الْجَنَّةَ. ‘তোমাদের প্রতিপালক আনন্দিত হন ঐ ছাগলের রাখালের প্রতি, যে একাই পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে ছালাতের আযান দেয় এবং ছালাত আদায় করে। আল্লাহ তা‘আলা তখন ফেরেশতাগণকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা আমার বান্দার প্রতি লক্ষ্য কর, সে আমার ভয়ে আযান দিচ্ছে এবং ছালাত আদায় করছে। আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালাম’।[7]
উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের একদল লোক বলে যে, ‘আসুন ভাই আসুন খুশি-খুশি জামায়াতের সহিত নামায পড়ি। বহুত ফায়দা আছে’। অথচ দেরী করে ছালাত আদায় করে আর উপরের হাদীছ প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা নির্দিষ্ট সময়ে ছালাত আদায় ফরয করেছেন। অতএব একা হ’লেও ঐ সময়ই ছালাত আদায় করতে হবে, তবুও দেরিতে ছালাত আদায় করা যাবে না। এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চৌদ্দশত বছর পূর্বে জানিয়ে দিয়ে গেছেন।
দ্বিতীয়তঃ ছালাত আদায় করেও জাহান্নামে যাবে ঐসব মুছল্লী যারা রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে ছালাত আদায় না করে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِىْ أُصَلِّى ‘তোমরা আমাকে যেভাবে ছালাত আদায় করতে দেখ, ঠিক সেভাবেই ছালাত আদায় কর’।[8]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেভাবে ছালাত আদায় করেছেন, সেভাবে ছালাত আদায় করতে গেলে অবশ্যই ছহীহ হাদীছের আলোকেই ছালাত আদায় করতে হবে। কোন ইমাম, তরীকা বা মাযহাবের পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করলে সেটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পদ্ধতির ছালাত হবে না। যেমন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাক্ষাতে তিন, তিন বার ছালাত আদায় করেও তা সঠিক বলে গণ্য হয়নি। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم دَخَلَ الْمَسْجِدَ، فَدَخَلَ رَجُلٌ فَصَلَّى فَسَلَّمَ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَرَدَّ وَقَالَ ارْجِعْ فَصَلِّ، فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ. فَرَجَعَ يُصَلِّى كَمَا صَلَّى ثُمَّ جَاءَ فَسَلَّمَ عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ارْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ ثَلاَثًا. فَقَالَ وَالَّذِى بَعَثَكَ بِالْحَقِّ مَا أُحْسِنُ غَيْرَهُ فَعَلِّمْنِى. فَقَالَ إِذَا قُمْتَ إِلَى الصَّلاَةِ فَكَبِّرْ، ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ، ثُمَّ ارْكَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ رَاكِعًا، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَعْتَدِلَ قَائِمًا، ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ جَالِسًا، وَافْعَلْ ذَلِكَ فِى صَلاَتِكَ كُلِّهَا.
‘রাসূল (ছাঃ) মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন জনৈক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে ছালাত আদায় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সালাম দিল। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, তুমি যাও, পুনরায় ছালাত আদায় কর। কেননা তুমি ছালাত আদায় করনি। এভাবে লোকটি তিন বার ছালাত আদায় করল। রাসূল (ছাঃ) তাকে তিন বারই ফিরিয়ে দিলেন। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম করে বলছি, এর চাইতে সুন্দরভাবে আমি ছালাত আদায় করতে জানি না। অতএব আমাকে ছালাত শিখিয়ে দিন! অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যখন তুমি ছালাতে দাঁড়াবে তখন তাকবীর দিবে। অতঃপর কুরআন থেকে যা পাঠ করা তোমার কাছে সহজ মনে হবে, তা পাঠ করবে। তারপর ধীরস্থিরভাবে রুকূ করবে। অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর ধীরস্থিরভাবে সাথে সিজদা করবে। অতঃপর মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসবে। আর প্রত্যেক ছালাত এভাবে আদায় করবে’।[9]
বিজ্ঞ পাঠক! উপরের হাদীছ দ্বারা ছালাতে দ্রুততার সাথে কিয়াম-কুউদ ও রুকূ-সিজদা করার পরিণতি জানা গেল। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,أَسْوَأُ النَّاسِ سَرِقَةً الَّذِى يَسْرِقُ مِنْ صَلاَتِهِ. قَالُوْا يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ يَسْرِقُ مِنْ صَلاَتِهِ؟ قَالَ لاَ يُتِمُّ رُكُوْعَهَا وَلاَ سُجُوْدَهَا. ‘মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় চোর ঐ ব্যক্তি যে তার ছালাত চুরি করে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সে কিভাবে ছালাত চুরি করে? তিনি বললেন, সে ছালাতে রুকূ ও সিজদা পূর্ণ করে না’।[10]
রাসূল (ছাঃ)-এর ভাষায় বড় চোর হচ্ছে যারা ছালাতের মধ্যে চুরি করে। পার্থিব জীবনে মানুষ মানুষের ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা চুরি করে, এটাকে সামান্য চুরি বলা যেতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের মহামূল্যবান সম্পদ, জান্নাতে যাওয়ার পুঁজি, কত ইবাদতের মাঝে শ্রেষ্ঠ ইবাদত চুরি করে সেই প্রকৃতপক্ষে বড় চোর।
বস্ত্ততঃ রুকূ-সিজদা যথাযথভাবে না করলে ছালাতই হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الصَّلاَةُ ثَلاَثَةُ أَثْلاَثٍ الطُّهُوْرُ ثُلُثٌ وَالرُّكُوْعُ ثُلُثٌ وَالسُّجُوْدُ ثُلُثٌ فَمَنْ أَدَّهَا بِحَقِّهَا قُبِلَتْ مِنْهُ وَقُبِلَ مِنْهُ سَائِرُ عَمَلِهِ وَمَنْ رُدَّتْ عَلَيْهِ صَلاَتُهُ رُدَّ عَلَيْهِ سَائِرُ عَمَلِهِ- ‘ছালাতের ছওয়াব তিনভাগে বিভক্ত। এক-তৃতীয়াংশ পবিত্রতা, এক-তৃতীয়াংশ রুকূ ও এক-তৃতীয়াংশ সিজদায়। যে এইগুলি পূর্ণ আদায় করল তার ছালাত কবুল হ’ল এবং তার সমস্ত আমলও কবুল হ’ল। আর যার ছালাত কবুল করা হবে না, তার কোন আমলই কবুল হবে না’।[11]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَنْظُرُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى صَلاَةِ عَبْدٍ لاَ يُقِيمُ فِيْهَا صُلْبَهُ بَيْنَ رُكُوْعِهَا وَسُجُوْدِهَا. ‘আল্লাহ তা‘আলা ঐ বান্দার ছালাতের প্রতি দৃষ্টি দেন না, যে ছালাতে রুকূ ও সিজদায় পিঠ সোজা করে না’।[12] অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, إنَّ الرَّجُلَ لَيُصَلِّي سِتِّينَ سَنَةً مَا تُقْبَلُ لَهُ صَلاَةٌ، لَعَلَّهُ يُتِمُّ الرُّكُوعَ، وَلاَ يُتِمُّ السُّجُودَ، وَيُتِمُّ السُّجُودَ، وَلاَ يُتِمُّ الرُّكُوعَ. ‘নিশ্চয়ই কোন মছুল্লী ৬০ বছর যাবৎ ছালাত আদায় করছে, কিন্তু তার ছালাত কবুল হচ্ছে না। হয়ত সে পূর্ণভাবে রুকূ করে কিন্তু সিজদা পূর্ণভাবে করে না। অথবা পূর্ণভাবে সিজদা করে কিন্তু পূর্ণভাবে রুকূ করে না’।[13] অন্য বর্ণনায় আছে আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تُجْزِئُ صَلاَةُ الرَّجُلِ حَتَّى يُقِيْمَ ظَهْرَهُ فِى الرُّكُوْعِ وَالسُّجُوْدِ. ‘মুছল্লীর ছালাত ততক্ষণ পর্যন্ত যথেষ্ট হবে না যতক্ষণ সে রুকূ ও সিজদায় তার পীঠ সোজা না করবে।[14]
তৃতীয়তঃ যারা লোক দেখানো ছালাত আদায় করে। মহান আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ هُمْ يُرَاءُوْنَ ‘যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে’ (মাঊন ১০৭/৬)। এটা হচ্ছে মুনাফিকদের ছালাত। যেমন মহান আল্লাহ অপর আয়াতে বলেছেন,
إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوْا كُسَالَى يُرَاءُوْنَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُوْنَ اللهَ إِلَّا قَلِيْلًا-
‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়, আর তিনিও তাদের ধোঁকায় ফেলেন। যখন ওরা ছালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায় লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)।
ইমাম সুয়ূতী বলেন, মুনাফিকদের ধোঁকা হ’ল লোক দেখানো ছালাত আদায় করা। এভাবে তারা যেন আল্লাহকে ধোঁকা দেয় যে, তারা ছালাত আদায় করে থাকে। অথচ আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর রাখেন। আর আল্লাহ তাদের ধোঁকায় ফেলেন অর্থ ওদের লোক দেখানো ছালাত জানা সত্ত্বেও তিনি তাদের দুনিয়াতে জান-মালের নিরাপত্তা দান করেন। অথচ আখেরাতে তাদের জন্য জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে স্থান নির্ধারণ করেন (নিসা ৪/১৪৫)।[15]
উক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এ নির্বোধ মুনাফিকরা আল্লাহ তা‘আলার সাথে প্রতারণা করছে। অথচ তিনি তাদের অন্তরের সমস্ত কথা সম্যক অবগত রয়েছেন। তাদের স্বল্প বুদ্ধির কারণে এ মুনাফিকরা মনে করে নিয়েছে যে, তাদের কপটতা যেমন দুনিয়াতে চলছে তদ্রূপ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সমীপেও চলবে। আসলে কিয়ামতের দিন তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তারা মুসলমানদের আলোর উপর নির্ভর করে থাকতে চাইবে। কিন্তু তাওহীদবাদী খাঁটি মুসলিমগণ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তখন মুনাফিকরা মুসলমানদেরকে ডেকে বলবে, তোমরা থাম, আমরা তোমাদের আলোর সাহায্য চাই। মুসলমানরা তখন উত্তর দিবে, তোমরা পিছনে ফিরে যাও এবং আলো অনুসন্ধান কর। তখন তারা পিছনে ফিরবে। এমন সময় তাদের মধ্যে পর্দা পড়ে যাবে। আফসোস! মুসলমানদের মাঝে থাকবে আল্লাহর পক্ষ হ’তে করুণা ও দয়া। আর মুনাফিকদের জন্য থাকবে দুঃখ-বেদনা।
ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মুনাফিকদের উপর সবচেয়ে ভারী ছালাত হচ্ছে এশা ও ফজরের ছালাত। যদি তারা এই ছালাতের ফযীলতের কথা জানত, তবে হাঁটুতে ভর দিয়ে হ’লেও এ ছালাতে হাযির হ’ত। কাজেই আমি তখন ইচ্ছা করি যে, তাকবীর দিয়ে কাউকে ইমামতির স্থানে দাঁড় করতঃ ছালাত আরম্ভ করিয়ে দেই, অতঃপর আমি লোকদেরকে বলি যে, তারা যেন জ্বালানী কাঠ নিয়ে এসে ঐ লোকদের বাড়ীর চতুর্দিকে রেখে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং তাদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়। যারা জামা‘আতে হাযির হয় না’।[16]
মূলতঃ লোক দেখানো কোন আমল আল্লাহ কবুল করেন না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللهُ بِهِ ‘যে ব্যক্তি লোককে শুনানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তাকে দিয়েই তা শুনিয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তার মাধ্যমে তা দেখিয়ে দেন’।[17] অর্থাৎ আল্লাহ তাকে লজ্জিত করেন এবং স্পষ্ট করে
দেন যে, সে আদৌ মোখলেছ নয়। বস্ত্ততঃ পূর্ণ আল্লাহভীতি এবং খুশূ-খুযূ ও একাগ্রতা ব্যতীত ছালাত কবুল হয় না। আর লোক দেখানো আমলকারীকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[18]
পরিশেষে বলব, সঠিক সময়ে খালেছ অন্তরে রাসূল (ছাঃ)-এর তরীকায় তথা ছহীহ হাদীছ মোতাবেক ছালাত আদায় করতে হবে। অন্যথা ছালাত আদায় করেও জাহান্নামী হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে ছালাত আদায়ের তাওফীক দিন-আমীন!
[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা, পৃঃ ৫০১।
[2]. কুরতুবী হা/৬৪৮৩; বাযযার, ত্বাবারী, বায়হাক্বী। তবে বায়হাক্বী সা‘দ থেকে ‘মওকূফ’ সূত্রে বর্ণনা করার পর সেটাকেই ‘সঠিক’ বলেছেন (২/২১৪-১৫)। হায়ছামী একে ‘হাসান’ বলেছেন (১/৩২৫)।
[3]. মুসলিম হা/৬২২; মিশকাত হা/৫৯৩।
[4]. বুখারী হা/৫২৭, ই.ফা.বা. হা/২১৮, পৃঃ ৫০২; মুসলিম হা/৮৫।
[5]. আবুদাঊদ হা/৪২৬; তিরমিযী হা/১৭০; মিশকাত হা/৬০৭, সনদ ছহীহ।
[6]. মুসলিম হা/৬৪৮; ই.ফা. বা. হা/১৩৩৮; মিশকাত হা/৬০০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৫৫২, ২/১৭৭।
[7]. আবু দাঊদ হা/১২০৩; সনদ ছহীহ; নাসাঈ হা/৬৬৬; ছহীহাহ হা/৪১; মিশকাত হা/৬৬৫, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬১৪, ২/২০২ পৃঃ।
[8]. বুখারী হা/৬৩১; মিশকাত হা/৬৮৩।
[9]. বুখারী হা/৭৫৭; তিরমিযী হা/৩০৩; নাসাঈ হা/৮৮৪; মিশকাত হা/৭৯০ ‘ছালাতের বিবারণ’ অধ্যায়।
[10]. মুসনাদে আহামাদ হা/২২৬৯৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৯৮৬; মিশকাত হা/৮৮৫।
[11]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৪৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৩৯।
[12]. আহমাদ হা/১৬৩২৬; ছহীহাহ হা/২৫৩৬; মিশকাত হা/৯০৪।
[13]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৯৬৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫২৯; ছহীহাহ হা/২৫৩৫, সনদ হাসান।
[14]. আবুদাঊদ হা/৮৫৫, ১/১২৪; মিশকাত হা/৮৭৮; ছহীহ তারগীব হা/৫২৮, তাবরানী কাবীর হা/৩৭৪৮।
[15]. তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা, পৃঃ ৫০৩।
[16]. মুসলিম হা/৬৫১।
[17]. বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬ ‘শুনানো ও দেখানো’ অনুচ্ছেদ।
[18]. মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত ২০৫।
{{{সৌজন্যেঃ সত্যের দিকে আহবান}}}