রুকন হচ্ছে এমন বিষয়, যার অনুপস্থিতিতে অন্য একটি বিষয়ের অনুপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে উঠে। রুকন অবশ্যই মূল বিষয়টির অন্তর্গত হওয়া চাই। যেহেতু রুকন কোন জিনিসের আভ্যন্তরীণ বা ভেতরের বিষয়, সেহেতু শুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি এর উপর নির্ভরশীল। অতএব কোন জিনিসের রুকন ব্যতীত তা সহীহ বা শুদ্ধ হয় না। রুকন কি জিনিস, এটা জানার পর আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে যে, যে তাওহীদ আল্লাহ তায়ালা আপনার ওপর ওয়াজিব করে দিয়েছেন, সে তাওহীদেরও সালাতের মতোই রুকন আছে। সালাত যেমন তার রুকন যথা- তাকবীরে তাহরিমা, র�কু, সেজদা, শেষ বৈঠক ইত্যাদি আদায় করা ব্যতীত শুদ্ধ হয় না, কোনো ব্যক্তি যদি সালাতের কোনো রুকন বাদ দেয় তাহলে তার সালাত যেমন ভাবে বাতিল হয়ে যায়, তেমনি ভাবে কোনো ব্যক্তি যদি তাওহীদের কোনো একটি রুকন বাদ দেয়, তাহলে সে ব্যক্তিও আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারবে না। এমতাবস্থায় কলেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ‘ তার কোনো কাজে আসবে না, সে আর মুসলিম থাকবে না বরং সে কাফেরে পরিণত হয়ে যাবে।
//
তাওহীদের দুটি রুকন (মৌলিক উপাদান) তাওহীদের প্রথম রুকন বা মৌলিক বিষয় হচ্ছে “কুফর বিত ত্বাগুত বা তাগুতকে অস্বীকার করা”। আর দ্বিতীয় রুকন বা মৌলিক বিষয় হচ্ছে “ঈমান বিল্লাহ বা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা”। এর প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার নিম্মোক্ত বানীঃ “যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করলো আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলো, সে এমন এক শক্ত রজ্জু ধারণ করলো যা কখনো ছিড়ে যাবার নয়”। (আল-বাক্বারাহ ২: ২৫৬)
//
ﺎ ﻣ ﺑ ﻠ উপরোক্ত আয়াতের ﻓﻤﻦ ﻳﻜﻔﺮ ﺍﻟﻄﺎﻏﻮﺕ হচেছ ১ম রোকন, ﺆﻥ ﺑ ﮦ ﻝ হচেছ ২য় রোকন এবং ﺍﻟﻌﺮﻭﺓ ﺍﻟﻮﺛﻘﻰ (শক্ত রজ্জু) বলতে কলেমা কে বুঝানো হয়েছে। আর এটাই মূলতঃ তাওহীদের কলেমা।
//
সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে রাস�ল (সঃ) ইরশাদ করেছেনঃ “যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বললো আর আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল উপাস্যকে অস্বীকার করলো তার জান ও মাল পবিত্র “(অর্থাৎ কাফেরদের জান ও মালের মতো গনিমতের মাল নয়।) এবং তার হিসাবের ভার আল্লাহর ওপরই ন্যস্ত (অর্থাৎ মনের কুফরীর বিচার আল্লাহই করবেন।)
//
প্রথম রুকনঃ তাগুতকে অস্বীকার করা
প্রিয় পাঠক ! (আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথের দিশা দান কর�ন) আপনাকে জেনে রাখতে হবে যে, তাগুতের কুফরী ব্যতীত একজন বান্দা কখনো “মুওয়াহ্যিদ” (আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী) হতে পারে না। আর তাগুত কি জিনিস তা জানা ব্যতীত, তাগুতকে অস্বীকার করা কখনো সম্ভব নয়।
//
তাগুত এর আভিধানিক সংজ্ঞাঃ তাগুত শব্দের অর্থ হচ্ছে সীমালংঘনকারী, আল্লাহদ্রোহী, বিপথে পরিচালনাকারী। তাগুত শব্দটি আরবী (তুগইয়ান) শব্দ থেকে উৎসারিত, যার অর্থ সীমালংঘন করা, বাড়াবাড়ি করা, স্বেচ্ছাচারিতা। শব্দের ক্রিয়ামূল (ত্বগা) এবং বহুবচন । যেমন পানির একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। নূহ (আঃ) এর সময় যখন জলোচ্ছাস হয়েছিল তখন পানি তার এ সীমা অতিক্রম করেছিল, এ ঘটনাকে কোরআনে এভাবে বলা হয়েছেঃ ‘‘যখন জ্বলোচ্ছাস হয়েছিল তখন আমি তোমাদেরকে চলন্ত নৌযানে আরোহন করিয়েছিলাম”। (সূরা, হাক্কা-৬৯:১১)
কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতায়ালা সাধারণ সীমালংঘন এবং সুনির্দিষ্ট সীমালংঘনের বর্ণনা দিতে ব্যবহার করেছেন। যেমন সাধারন সীমালংঘন অর্থে কোরআনে ক্রিয়াটি ব্যবহৃত হয়েছে-
ﻛَﻼَّ ﺇِﻥَّ ﺍﻹِْﻧﺴَﺎﻥَ ﻟَﻴَﻄْﻐَﻰ অর্থাৎ “বস্তুত মানুষতো সীমালংঘন ( ﻟَﻴَﻄْﻐَﻰ লা ইয়াতগা) করেই থাকে।” (সূরা, ‘আলাক- ৯৬:৬)
//
ﺃَﻻَّ ﺗَﻄْﻐَﻮْﺍ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻤِﻴﺰَﺍﻥِ “যাতে তোমরা সীমালংঘন ( ﺗَﻄْﻐَﻮ লা তাতগা) না কর মানদন্ডে।” (সূরা, আর রাহমান-৫৫:৮)
সুনির্দিষ্ট সীমালংঘন অর্থে ক্রিয়াটি ব্যবহৃত হয়েছে (হালাল খাবার সম্পর্কে): “তোমাদিগকে আমি যা দিয়েছি তা থেকে পবিত্র বস্তুসমূহ খাও এবং সীমালংঘন করো না, তাহলে তোমাদের উপর আমার ক্রোধ নেমে আসবে এবং যার উপর আমার ক্রোধ নেমে আসবে সে ধ্বংস হয়ে যায়।” (সূরা, ত্ব-হাঃ ৮১)
//
যারা অবিশ্বাসী হয়ে সীমালংঘন করে আল্লাহ তাদের জন্যও এ ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে রব এবং ইলাহ (ইবাদতের যোগ্য) হিসেবে গ্রহন করে সীমালংঘন করেছে কোরআনে সে কাফিরদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘য়ালা (ত্বা-গি-ন) বলেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘য়ালা বলেনঃ “আর সীমালংঘনকারীদের (লিত ত্বাগিন) জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট পরিণাম।” (সূরা, ছোয়াদ-৩৮:৫৫) “প্রকাশ করা হবে জাহান্নাম, অনন্তর যে সীমালংঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয়।” (সূরা, নাযিয়াত-৭৯: ৩৬-৩৮) অর্থাৎ “ছামুদ সম্প্রদায় অবাধ্যতায় (বি ত্বাগওয়াহা~) অস্বীকার করেছিল।” (সূরা, শামস-৯১:১১)
আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাগুতকে বর্জনের অপরিহার্যতা
প্রত্যেক ব্যক্তির এই জ্ঞান থাকা উচিৎ যে,সমস্ত জীব ও জড়ের সূচনা ও কর্তৃত্ব মহান আল্লাহর।
সালাত, যাকাত বা অন্যান্য ইবাদতের পূর্বে যে দৃঢ় ব্যাপার মহান আল্লাহ আদম (আঃ) এর সন্তানদের আদেশ করেছেন তা হল আল্লাহ তা’য়ালা একত্বের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং অন্য সমস্ত উপাস্যগুলোকে (তাগুত) পরিত্যাগ ও অস্বীকার করা।
এর জন্যই আল্লাহ জীব সৃষ্টি করলেন, নবীদের প্রেরণ করলেন, আসমানী কিতাবগুলো নাযিল করলেন এবং আদেশ দিলেন জিহাদ ও শাহাদাতের। এর জন্যই মহান আল্লাহর বান্দা ও শয়তানের অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে শত্রুতা আর এর দ্বারাই মুসলিম জাতি ও সঠিক খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন এবং মানুষকে এইজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।” (সূরা-যারিয়াত: ৫৬) এর অর্থ একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করা। তিনি আরও বলেনঃ “আল্লাহর ইবাদত করিবার ও তাগুতকে বর্জন করবার নির্দেশ দিবার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি।” (সূরা-নাহল: ৩৬)
কোন ইলাহ নাই আল্লাহ ব্যতীত (আক্ষরিক কোন উপাস্য বা ইবাদতের যোগ্য কোন কিছু বা কেউ নাই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া), এই বিশ্বাস হচ্ছে ইসলামের মূল বা ভিত্তি। এই বিশ্বাসের অবর্তমানে কোন দাওয়া, জিহাদ, সালাত, সওম, যাকাত বা হজ্জ কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। কোন ব্যক্তিকেই জাহান্নামের আগুন থেকে বাচাঁনো যাবে না যদি না সে এই ভিত্তির প্রতি ঈমান না এনে থাকে। কারণ এটাই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের প্রতি আদেশকৃত অলঙ্ঘনীয় ভিত্তি। এই ভিত্তির অবর্তমানে দ্বীন-ইসলামের অন্যান্য স্তম্ভগুলো কোন ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন হতে নিরাপদে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ “—-যে তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনও ভাঙ্গবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা-বাকারা:২৫৬)
মহান আল্লাহ আরও বলেনঃ “যারা ত্বাগুতের ইবাদত হতে দূরে থাকে এবং আল্লাহর অভিমূখী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে।” (সূরা-যুমার:১৭) লক্ষ্য করুন কেমন করে আল্লাহ
তা’আলা তাঁর নিজের প্রতি ঈমান আনার পূর্বে সকল (মিথ্যা) উপাস্যদের অস্বীকার ও অবিশ্বাস করার কথা বলেছেন, যেমন তিনি ঈমান আনয়নের পূর্বে কুফরকে ত্যাগ করার কথা বলেছেন।
//
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এই শব্দগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার একত্ববাদের আদেশ দিয়েছেন যা কিনা ইসলামের এই মজবুত ভিত্তির গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতির দিকে লক্ষ্য আরোপ করে। অতএব, সকল (মিথ্যা) উপাস্যদের চরম মাত্রায় অস্বীকার করা ব্যতীত মহান আল্লাহর প্রতি একনিষ্ট ঈমান পোষণ করা যায় না। তাগুতকে চেনার পর নিশ্চয়ই তাগুতকে অস্বীকার করার অপরিহার্যতা কি বুঝতে পারছেন। কারণ এটা অসম্ভব যে, কোন ব্যাপারে বিশ্বাস করা, যতক্ষন না এ বিশ্বাসের বিপরীত কিছুকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করা হয়। উদাহরণস্বরুপ কেউ যদি দাবী করে, ‘আমি এক ইলাহকে বিশ্বাস করি।’
অত:পর সে বলল, ‘আমি দুই ইলাহকে বিশ্বাস করি’। ঐ ব্যক্তির দ্বিতীয় উক্তি প্রথম স্বীকারোক্তিকে মিথ্যায় পরিণত করে বা অস্বীকার করে। কারণ দ্বিতীয় উক্তি প্রথম উক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত। এর অর্থ হচ্ছে তার একটা দাবী মিথ্যা অথবা উভয়টিই মিথ্যা। এজন্যই ঐরকম উক্তি সত্যকে মিথ্যা এবং অগ্রহনযোগ্য করে দেয়। সুনিশ্চিত সত্য একটা ব্যাপারে দু‘টি বিপরীতমুখী দিক থাকতে পারে না, যা ঐ নিশ্চিত বিষয়কে অস্বীকার করে।
//
তাগুতকে অস্বীকার করা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের অনিবার্য দাবী। তাওহীদের প্রথম রুকনই হচ্ছে তাগুতকে অস্বীকার করা, সুতরাং তাগুতকে বর্জন না করলে আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবী হবে অর্থহীন। ঈমানের প্রথম স্তম্ভ আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষনা দেয়া । প্রথম অংশ অস্বীকার করে দ্বিতীয় অংশ এর বিরোধী বা বিপরীত কোন কিছুকে।
//
নিচের আয়াতটি এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয় যে, ত্বাগুতকে মেনে নেয়া এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করার সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘য়ালা বলেনঃ অর্থাৎ “আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসুল প্রেরণ করেছি আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য।” (সূরা, নাহল-১৬:৩৬) সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করল না সে নবীদের মূল দাওয়াতকে অস্বীকার করল এবং মূলতঃ আল্লাহর ইবাদত করতে অস্বীকার করল। কারণ প্রত্যেক নবী তাদের কওমকে তাগুতের ইবাদতকে পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছিলেন।
//
এখন কেউ যদি নিজেকে ঈমানদার দাবী করে তাকে অবশ্যই তাগুতকে বর্জন করতে হবে। কারণ যে কালেমার স্বীকৃতি দিয়ে সে ইসলামে এসেছে সে কলিমার প্রথমাংশ ঘোষণা করার মাধ্যমে যাবতীয় বাতিল মা‘বুদকে অর্থাৎ তাগুত বর্জনের দৃঢ় ঘোষণা দিয়েছে এবং দ্বিতীয় অংশ ঘোষণার মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহকে ইলাহ হিসাবে মেনে নিয়েছে। সুতরাং তাগুতকে বর্জন না করলে ঈমানের দাবী মিথ্যা প্রমানিত হবে। যারা এই তাগুতদের মানে তারা আল্লাহকে মানতে পারে না, আর যারা আল্লাহকে মানে তারা তাগুতদের মানতে পারে না।
তবে হ্যাঁ, এমন অনেক ব্যক্তি আছে আল্লাহকে মানে আবার তাগুতদেরকেও মানে, কিন্তু আসলে যে আল্লাহকে মানা হয় না এ বোধ তাদের নেই। আর বর্তমানে অধিকাংশ লোকদের অবস্থাই এরকম।
//
উদাহরণস্বরূপ, কোরআন মাজীদে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা ঐ ব্যক্তির ঈমানের মূল্যহীনতার কথা বলেছেন যে ব্যক্তি নিজেকে ঈমানদার দাবী করে আবার তাগুতের কাছে বিচার-ফায়সালা চায়, আল্লাহ তা‘য়ালা বলেনঃ “আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি, যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি তারা ঈমান আনয়ন করেছে। তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়কে ফয়সালার জন্য তাগুতের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদের প্রতি তাকে (তাগুতকে) অমান্য করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” (আন-নিসাঃ ৬০)
যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কিংবা আল্লাহর পাশাপাশি তাগুতের ইবাদত করে তাদের উপর আল্লাহর লানৎ বর্ষিত হবে। আল্লাহতা‘য়ালা বলেন- “তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, যারা মান্য করে প্রতিমা ও শয়তানকে এবং কাফেরদেরকে বলে যে, এরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের উপর লা’নত করেছেন আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং। বস্তুতঃ আল্লাহ যার উপর লা’নত করেন তুমি তার কোন সাহায্যকারী খুঁজে পাবে না”। (সূরা নিসা ৪:৫১-৫২)
পূর্ববর্তী জাতি যারা তাগুতের ইবাদত করেছিল তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেনঃ “বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি, তাদের মধ্যে কার মন্দ প্রতিফল রয়েছে আল্লাহর কাছে? যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের প্রতি তিনি ক্রোধাম্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে বানর ও শুকরে রূপান্তরিত করে দিয়েছেন এবং যারা শয়তানের আরাধনা করেছে, তারাই মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সত্যপথ থেকেও অনেক দূরে।” (সূরা মায়েদাহ-৫:৬০)
আর যারা তাগুতের ইবাদতকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহ তাদের সুসংবাদ প্রদান করেনঃ
“যারা শয়তানী শক্তির পূজা-অর্চনা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্যে রয়েছে সুসংবাদ। অতএব, সুসংবাদ দিন আমার বান্দাদেরকে।যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।” (সূরা যুমার ৩৯:১৭-১৮)
যারা তাগুতের ইবাদতকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহ তাদের ওয়ালী হবেনঃ “যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোযখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে”। (সূরা বাকারা ২:২৫৭)
তাগুত শব্দের শর‘য়ী সংজ্ঞা
এখানে আমরা আলোচনা করব তাগুত শব্দের শার’য়ী অর্থ নিয়ে তা, এজন্য যে কোরআন-সু্ন্নাহয় যখন কোন শব্দ ব্যবহৃত হয় তখন তার একটা নির্দিষ্ট শার’য়ী অর্থ দাড়ায়। তাগুত শব্দটি আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ওহী দ্বারা সাব্যস্ত, যা আক্বীদার সাথে সম্পৃক্ত। তাগুত’ এর ভাষাগত মূল (ত্বা-গি-ন) এর মত একই রকম মূল হলেও তাগুত হচ্ছে সীমালংঘনের সুনির্দিষ্ট ধরণ। সীমালংঘন করলেই ত্বাগুত হয়ে যায় না, যেমন আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র (হালাল) খাবার খাওয়ার জন্য এবং এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি বা সীমালংঘন না করার জন্য (সূরা, ত্ব-হা ২০:৮১)।
এখন কেউ যদি হারাম খায় তাহলে সে ত্বাগুত হয়ে যাবে না, বরং সে অবাধ্য হবে। এরকম অন্যান্য পাপের ক্ষেত্রেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধরনের পাপ বা সীমালংঘন কুফর, শিরক্, নিফাক্ পর্যন্ত পৌছতে পারে কিন্তু এ কারণে কেউ ত্বাগুত হয়ে যায় না। বরং ত্বাগুত হবে ঐ রকম সীমালংঘনের ক্ষেত্রে যখন কোন ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর সাথে শরীক্ করে। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট, যে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করে সে মুশরিক কিন্তু সে ত্বাগুত নয়। আল্লাহ তাকে ত্বা-গি-ন বলেছেন। আর তাগুত হচ্ছে সে যে নিজেকে (মিথ্যা) রব এবং ইলাহ (অর্থাৎ ইবাদতের যোগ্য) বানিয়ে নেয়। এজন্যই সব তাগুতেরা ত্বা-গি-ন কিন্তু সব ত্বা-গি-নেরা তাগুত নয়।
//
যে ব্যক্তি আল্লাহর অধিকার, গুনাবলী, কার্যাবলী ও সত্তার দাবীতে সীমালংঘন করে সে তাগুত। আল্লাহ ব্যতীত যে কেউ ইবাদত গ্রহন করে বা দাবী করে সে তাগুত এবং যে কেউ আল্লাহর গুনাবলী দাবী করে সেও ত্বাগুত। তাগুত হচেছ সেই ব্যক্তি যে নিজের প্রতি আল্লাহর কার্যাবলী বা গুনাবলী আরোপ করে।
যেমন ফেরাউন আল্লাহ দ্রোহী হয়েছিল এবং সীমালংঘন করেছিল, আল্লাহ সার্বভৌমত্বের মালিক অথচ সে নিজে মিসরের সার্বভৌমত্ব দাবী করেছিল। সে লোকদেরকে জড়ো করে ভাষণ দিয়েছিল যা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছেঃ “ফেরাউন তার জাতির উদ্দেশ্যে (এক) ভাষণ দিলো। সে বললো, মিশরের সার্বভৌমত্ব কি আমার নয়? তোমরা কি দেখছো না যে, এই নদীগুলো আমার (রাজত্বের) অধীনেই বয়ে চলছে——–।” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৫১)
//
আল্লাহতা‘য়ালা তাকে ‘ত্বাগা’ বলেছেন সূরা ত্বাহার ২৪ নং আয়াতে এবং মুসা (আঃ) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কাছে যাওয়ার জন্য- “ফেরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালংঘন করেছে।” শরীয়তের পরিভাষায়, এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই তাগুত যে, আল্লাহদ্রোহী হয়েছে এবং সীমালংঘন করেছে, আর আল্লাহর কোনো হককে নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছে এবং এমন বিষয়ে নিজেকে আল্লাহর সাথে সমকক্ষ বানিয়েছে, যা একমাত্র আল্লাহর জন্য খাস।
সুস্পষ্ট ভাবে তাগুত এর অর্থ হচ্ছে, কোন মাখলুক (সৃষ্টি) নিন্মোক্ত তিনটি বিষয়ের যে কোন একটি বিষয়কে (আল্লাহর স্থলে) নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করাঃ-কোন মাখলুক (সৃষ্টি) কর্তৃক আল্লাহতা‘য়ালার কার্যাবলীর যে কোন কার্য সম্পাদনের বিষয়টি নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করা।
যেমন সৃষ্টি করা, রিজিক দান অথবা শরীয়ত (বিধান) রচনা। এসব বিষয়গুলো সম্পাদনের ব্যাপারকে যে ব্যক্তি নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করবে (অর্থাৎ কেউ যদি বলে, আমি সৃষ্টি করি,আমি বিধান দেই) সেই তাগুত ।
কোন মাখলুক (সৃষ্টি) আল্লাহতা‘য়ালার কোন সিফাত বা গুন কে নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করা। যেমন ইলমে গায়েব জানা। যদি কেউ তা করে (অর্থাৎ বলে আমি এলমে গায়েব জানি) তাহলে তাকে তাগুত হিসেবে গন্য করা হবে।
যে কোন ইবাদত মাখলুক কর্তৃক (বা সৃষ্টির) এর উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা । যেমনঃ দোয়া, মানত, নৈকট্য লাভের জন্য পশু জবাই অথবা বিচার ফায়সালা চাওয়া। যদি (কোন মাখলুক) এসব ইবাদত গ্রহন করে, দাবীকরে, আকাঙ্খা করে অথবা (নিজের জন্য) সম্পাদন করে, তাহলে সেই তাগুত।
এমনকি কেউ তার জন্য ইবাদত নিবেদন করলে যদি সে নীরব থাকে তাহলেও সে ত্বাগুত বলে গন্য হবে, যতক্ষন পর্যন্ত না সে নিজেকে এ থেকে পবিত্র ও মুক্ত করে নেয় এবং এ হক্ আল্লাহর একথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়।
উপরোক্ত যে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করেছি, তার যে কোন একটি যদি কেউ নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বা নিজের জন্য সম্পাদন করে তাহলে সে তাগুত হিসেবে গন্য এবং নিজেকে আল্লাহর সমকক্ষ করে নিল। ইমাম আত্ তাবারী (রহঃ) বলেন, “আল্লাহর দেয়া সীমালংঘনকারী মাত্রই তাগুত বলে চিহ্নিত, যার অধীনস্থ ব্যক্তিরা চাপের মুখে তার ইবাদত করে বা তাকে তোষামোদ করার জন্য বা তার আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য তার ইবাদত করে। এ (তাগুত) উপাস্যটি মানুষ কিংবা শয়তান বা মূর্তি অথবা অন্য যেকোন বস্তু হতে পারে।” (তাফসীরে তাবারী, ইফাবা/৫ম খন্ড, ২৫৬ নং আয়াতের তাফসীর)
//
আল্লামা ড: মুহাম্মদ তকীউদ্দীন হেলালী ও আল্লামা ড: মুহাম্মদ মুহসিন খান কর্তৃক অনুদিত কুরআন মাজীদের ইংরেজী অনুবাদের সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে উল্লেখিত ‘তাগুত’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- “ The word ‘Taaghoot’ covers a wide range of meaning: it means everything worshipped other that Allah, i.e. all false deities. It may be satan, devils,idols, stones, sun, stars, human beings.” অর্থাৎ “তাগুত” শব্দটি বিস্তৃত অর্থ বোঝায়ঃ এটার অর্থ আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয়। যেমন সকল মিথ্যা উপাস্য; এটা শয়তান, মৃত ব্যক্তির আত্মা, মুর্তি, পাথর, সূর্য, তারকা, অথবা কোন মানুষও হতে পারে। (The Noble Qur’an .English Translation , পৃষ্ঠা ৫৮)
সাইয়্যেদ কুতুব (রহ:) বলেন, “তাগুত বলতে সেইসব ব্যক্তি ও ব্যবস্থাকে বোঝায় যেগুলো ঐশী দ্বীন এবং নৈতিক, সামাজিক ও আইন-শৃঙ্খলাকে অবমাননা করে এবং আল্লাহ নির্দেশিত বা তার দেয়া দিক-নির্দেশনা থেকে উদ্ভুত নয় এমন সব মূল্যবোধ ও রীতিনীতির ভিত্তিতে এই জীবন ব্যবস্থা পরিচালনা করে।” (তাফসীরে ফি যিলালিল কোরআন)
ইমাম মালেক (রহ:) তাগুতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেনঃ “এমন প্রত্যেক জিনিসকেই তাগুত বলা হয়, আল্লাহ তা‘য়ালাকে বাদ দিয়ে যার ইবাদত করা হয়।” (ফতহুল ক্বাদীর, আল্লামা শওক্বানী) এ সংজ্ঞাটি উত্তম এবং ব্যাপক অর্থজ্ঞাপক। আল্লাহ ব্যতীত যারই ইবাদত করা হয় সেই এ সংজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত। যেসব উপাস্যকে ‘তাগুত’ হিসেবে গন্য করা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
=মূর্তি, এমন সব কবর, গাছ, পাথর ও অচেতন পদার্থ যে গুলোর উপাসনা করা হয়;
=আল্লাহর আইন ব্যাতীত এমন সব আইন যার মাধ্যমে বিচার ফায়সালা চাওয়া হয়;
=এমনসব বিচারক তাগুতের অন্তর্ভূক্ত যারা আল্লাহর আইনের বিরোধী আইনদ্বারা মানুষের মধ্যে বিচার ফায়সালা করে;
=শয়তান, যাদুকর, গনক (যারা ইলমে গায়েবের ব্যাপারে কথা বলে);
উপাস্য হতে যে রাজী;
=যারা আইন রচনা বা মানুষের জন্য হালাল-হারাম নির্ধারণ করে কিংবা করার অধিকার রাখে বলে মনে করে;
প্রধান প্রধান তাগুত
তাগুতের সংখ্যা অনেক। তবে পাঁচ ধরণের তাগুত নেতৃত্বের আসনে রয়েছেঃ
১. গায়রুলাহর ইবাদতের দিকে আহবানকারী শয়তান;
২. আল্লাহর আইন পরিবর্তনকারী জালেম শাসক;
৩. আল্লাহ তা‘য়ালার নাযিলকৃত বিধান ছাড়া যে বিচার-ফায়সালা করে;
৪. আল্লাহ ব্যতীত যে ব্যক্তি এলমে গায়েব জানে বলে দাবী করে;
৫. আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করা হয় এবং সে এই ইবাদত গ্রহণে রাজি বা খুশি থাকে।